মাসিক চলাকালে কী করবেন এবং কী করবেন না – স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সম্পূর্ণ গাইড
আসসালামু আলাইকুম সবাইকে । আপনারা কেমন আছেন? আশা করি মহান আল্লাহ তা'লার অশেষ মেহেরবানীতে সবাই ভালো আছেন । আজ আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করতে যাচ্ছি 'মাসিক চলাকালে কী করবেন এবং কী করবেন না' নিয়ে । সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়তে থাকুন, আশা করি সমাধান পেয়ে যাবেন ।
প্রিয় বোনেরা, মাসিক বা পিরিয়ড নারী জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে এটি আমাদের মাঝে ফিরে আসে এবং শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তনের সাক্ষী হই আমরা। অনেকেই এই সময়টাতে কিছুটা অস্বস্তি বা ব্যথায় ভোগেন, আবার কেউ কেউ বুঝে উঠতে পারেন না যে এই বিশেষ দিনগুলোতে নিজের যত্ন কীভাবে নেবেন। মাসিককালীন সঠিক জ্ঞান এবং যত্ন আমাদের এই সময়টাকে আরও সহজ ও স্বাস্থ্যকর করে তুলতে পারে। তাই, এই বিস্তারিত গাইডে আমরা আলোচনা করব মাসিক চলাকালীন সময়ে আপনার কী কী করা উচিত এবং কোন কোন বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা ভালো, যাতে আপনি সুস্থ ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারেন।
মাসিক চলাকালীন যা যা করবেন (Do's during Menstruation):
মাসিকের দিনগুলোতে শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং অস্বস্তি কমাতে কিছু বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। চলুন জেনে নিই কী কী করবেন:
১. সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন (Maintain Proper Hygiene):
- প্যাড/ট্যাম্পন/কাপ পরিবর্তন: প্রতি ৪-৬ ঘণ্টা অন্তর স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করুন। ট্যাম্পন ব্যবহার করলে তা সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা এবং মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে তা পরিষ্কার করে পুনরায় ব্যবহার করার আগে নির্দেশাবলী মেনে চলুন। দীর্ঘক্ষণ একই পণ্য ব্যবহারে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।
- ব্যক্তিগত অঙ্গ পরিষ্কার: প্রতিদিন হালকা গরম পানি দিয়ে যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করুন। কোনো ধরনের সুগন্ধিযুক্ত সাবান বা ভ্যাজাইনাল ডুশ ব্যবহার করবেন না, কারণ এগুলো যোনির স্বাভাবিক পিএইচ (pH) ভারসাম্য নষ্ট করে ইনফেকশনের কারণ হতে পারে।
- সঠিক নিষ্পত্তি: ব্যবহৃত প্যাড বা ট্যাম্পন কাগজে মুড়িয়ে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলুন। কমোডে ফেলবেন না, এতে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
২. সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন (Eat a Balanced and Nutritious Diet):
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার: মাসিকের সময় শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে যাওয়ায় আয়রনের ঘাটতি হতে পারে। পালং শাক, কচু শাক, ডিমের কুসুম, মুরগির মাংস, লাল মাংস, মাছ এবং বিভিন্ন প্রকার ডাল আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করুন।
- ভিটামিন সি: লেবু, আমলকী, পেয়ারা, কমলালেবুর মতো ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
- পর্যাপ্ত পানি: শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সারাদিন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। এটি পেট ফাঁপাভাব কমাতে এবং হজমশক্তি ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
- ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম: দুধ, দই, পনির, ছোট মাছ থেকে ক্যালসিয়াম এবং ডার্ক চকোলেট, বাদাম, কলা ও সবুজ শাকসবজি থেকে ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করুন। এগুলো মাসিকের ব্যথা ও পেশী সংকোচন কমাতে সহায়ক।
৩. হালকা ব্যায়াম ও শরীরচর্চা (Light Exercise and Physical Activity):
অনেকেই ভাবেন মাসিকের সময় ব্যায়াম করা উচিত নয়, যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। হালকা হাঁটাচলা, যোগব্যায়াম (যেমন: শিশুর আসন, বদ্ধ কোণাসন) বা স্ট্রেচিং মাসিকের ব্যথা কমাতে, রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে এবং মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। তবে, নিজের শরীরের উপর অতিরিক্ত চাপ দেবেন না।
৪. পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম (Get Enough Rest and Sleep):
মাসিকের সময় শরীর কিছুটা ক্লান্ত লাগতে পারে। তাই, প্রতি রাতে ৭-৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করুন। দিনের বেলায় ক্লান্তি লাগলে অল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিন।
৫. ব্যথা উপশমের ঘরোয়া উপায় (Home Remedies for Pain Relief):
- গরম সেঁক: তলপেটে হট ওয়াটার ব্যাগ বা গরম পানিতে ভেজানো তোয়ালে দিয়ে সেঁক দিলে ব্যথা অনেকটাই কমে আসে।
- ভেষজ পানীয়: আদা চা, ক্যামোমাইল চা, বা দারুচিনি মেশানো গরম পানি পান করলে ব্যথা উপশম হতে পারে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ: ব্যথা খুব বেশি হলে এবং ঘরোয়া উপায়ে না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে পারেন।
৬. আরামদায়ক পোশাক পরিধান করুন (Wear Comfortable Clothing):
এই সময়ে ঢিলেঢালা, সুতির এবং আরামদায়ক পোশাক পরুন। টাইট বা আঁটসাঁট পোশাক এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো অস্বস্তি বাড়াতে পারে।
৭. মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন (Take Care of Your Mental Health):
মাসিকের সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মেজাজ খিটখিটে (mood swings) হতে পারে। নিজের পছন্দের কাজ করুন, গান শুনুন, বই পড়ুন বা আপনজনদের সাথে কথা বলুন। মেডিটেশন বা হালকা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামও মন শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
৮. মাসিক চক্রের হিসাব রাখুন (Track Your Menstrual Cycle):
একটি ক্যালেন্ডার বা পিরিয়ড ট্র্যাকার অ্যাপ ব্যবহার করে আপনার মাসিক চক্রের হিসাব রাখুন। এতে পরবর্তী মাসিকের সম্ভাব্য তারিখ সম্পর্কে ধারণা থাকবে এবং কোনো অস্বাভাবিকতা (যেমন: অনিয়মিত মাসিক) হলে তা দ্রুত সনাক্ত করা যাবে।
মাসিক চলাকালীন যা যা করবেন না (Don'ts during Menstruation):
কিছু কাজ বা অভ্যাস মাসিকের সময় আপনার অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলতে পারে। সেগুলো এড়িয়ে চলা ভালো:
১. অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলুন (Avoid Unhealthy Foods):
- অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার: চিপস, ফাস্ট ফুড বা লবণাক্ত খাবার শরীরে পানি ধরে রেখে পেট ফাঁপাভাব ও ফোলাভাব বাড়াতে পারে।
- অতিরিক্ত চিনি: মিষ্টিজাতীয় খাবার বা পানীয় রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বাড়িয়ে বা কমিয়ে মেজাজের দ্রুত পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন: চা, কফি বা কোমল পানীয় বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে তা উদ্বেগ ও ঘুমের সমস্যা বাড়াতে পারে এবং কখনো কখনো পেটের ব্যথাও তীব্র করতে পারে।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার: এই ধরনের খাবারে পুষ্টিগুণ কম থাকে এবং এগুলো হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
২. অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করবেন না (Don't Overexert Yourself):
হালকা ব্যায়াম উপকারী হলেও, খুব ভারী বা কঠিন শরীরচর্চা এই সময়ে এড়িয়ে চলুন, যদি না আপনি নিয়মিতভাবে এটি করতে অভ্যস্ত থাকেন। শরীরের উপর অতিরিক্ত চাপ দেবেন না।
৩. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় অবহেলা করবেন না (Don't Neglect Personal Hygiene):
দীর্ঘক্ষণ একই স্যানিটারি প্যাড বা ট্যাম্পন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এবং দুর্গন্ধের কারণ হতে পারে। যোনির ভেতরে কোনো প্রকার সুগন্ধিযুক্ত স্প্রে বা ডুশ ব্যবহার করবেন না।
৪. ব্যথা বা অস্বস্তি চেপে রাখবেন না (Don't Ignore Pain or Discomfort):
যদি মাসিকের সময় আপনার অস্বাভাবিক রকমের তীব্র ব্যথা হয়, যা সাধারণ ব্যথানাশকেও কমে না, অথবা যদি আপনি অন্য কোনো গুরুতর শারীরিক সমস্যা অনুভব করেন, তবে তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৫. অনিরাপদ যৌন মিলন করবেন না (Avoid Unprotected Intercourse):
মাসিকের সময় যৌন মিলন করা বা না করা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। তবে, এই সময়ে জরায়ুমুখ কিছুটা খোলা থাকায় এবং রক্তের উপস্থিতির কারণে ইনফেকশনের ঝুঁকি সামান্য বেশি থাকতে পারে। তাই, মিলন করলে সুরক্ষার (যেমন: কনডম) ব্যবহার নিশ্চিত করুন।
৬. কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা এড়িয়ে চলুন (Avoid Believing Common Myths):
মাসিক নিয়ে সমাজে অনেক ভুল ধারণা বা কুসংস্কার প্রচলিত আছে, যেমন: এই সময়ে আচার ছোঁয়া যাবে না, টক খাওয়া যাবে না, গাছে পানি দেওয়া যাবে না ইত্যাদি। এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। संतुलित ও পুষ্টিকর সব খাবারই পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন (When to See a Doctor):
সাধারণত মাসিক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও, কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:
- অতিরিক্ত রক্তপাত: যদি প্রতি এক বা দুই ঘণ্টায় আপনার প্যাড বা ট্যাম্পন সম্পূর্ণ ভিজে যায়।
- দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাত: যদি আপনার মাসিক ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হয়।
- তীব্র ও অসহনীয় ব্যথা: যদি মাসিকের ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে এবং সাধারণ ব্যথানাশকেও উপশম না হয়।
- অনিয়মিত মাসিক: যদি আপনার মাসিক চক্র খুব ঘন ঘন (২১ দিনের আগে) বা অনেক দেরিতে (৩৫ দিনের পরে) হয়, অথবা হঠাৎ করে মাসিক বন্ধ হয়ে যায় (গর্ভধারণ বা মেনোপজ ছাড়া)।
- অন্তর্বর্তীকালীন রক্তপাত: দুটি মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ে হঠাৎ রক্তপাত হলে।
- অন্যান্য লক্ষণ: মাসিকের সাথে যদি জ্বর, অস্বাভাবিক দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, বা তলপেটে তীব্র ব্যথার মতো ইনফেকশনের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়।
আর্টিকেলের শেষ কথাঃ মাসিক চলাকালে কী করবেন এবং কী করবেন না
মাসিক কোনো অসুস্থতা বা লজ্জার বিষয় নয়, বরং এটি নারীত্বের একটি স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময়টাতে নিজের শরীরের প্রতি একটু বাড়তি মনোযোগ ও যত্ন নিলে আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকটাই সুস্থ ও সতেজ থাকতে পারবেন। সঠিক তথ্য জানুন, নিজের শরীরের কথা শুনুন এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার সুস্থতাই আপনার শক্তি।
আশা করি, এই গাইডটি আপনার মাসিককালীন দিনগুলোতে নিজের যত্ন নিতে সহায়ক হবে। আপনার কোনো প্রশ্ন বা অভিজ্ঞতা থাকলে নিচে কমেন্ট করে আমাদের জানাতে পারেন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!
আজকের আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url